| পিবিএন ডেস্ক
ছোটো ছোটো কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করবো। তারপর জেনে নিবো চাকরি পেতে বিশেষ করে বেসরকারি/ ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানির চাকুরী পেতে কি কি গুন থাকা দরকার আর কি কি দোষ বর্জন করা দরকার। অবশ্য গল্পের মধ্যেই অনেক কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে।
নিত্য অভিজ্ঞতাঃ ছোটোখাটো একটা বেসরকারি চাকরি করি। সেই সুবাদে অনেকে চাকরি চায়। চেষ্টাও করি কোনো বিধিব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্যে। একেক সময় একেক জন হঠাৎ হঠাৎ-ই চাকুরী চায়। সবাইকে এক সাথে মনে থাকে না বলে আমার নিজস্ব একটা জব হেল্পিং মেসেঞ্জার গ্রুপসহ আরো কয়েকটি বৃহৎ হেল্পিং গ্রুপের সাথে আমি কাজ করছি। সেই সুবাদে কিছু অভিজ্ঞতা – যাদেরকে নিয়ে লিখছি তাদের সিংহভাগই এমএ/বিএ/বিবিএ/এমবিএ কমপ্লিট ফ্রেশার।
নিত্য ঘটনাঃ ১. কোন সার্কুলার তার প্রোফাইলের সাথে ম্যাচ করে সেটা বোঝে না। ২. সিভি চাইলে মেসেঞ্জারে সিভির jpg Format মানে ছবি পাঠিয়ে দেয়। PDF বা Word Format সম্পর্কে আলাদা ক্লাস নিয়ে তারপর তার নিকট থেকে সিভি নেওয়া লাগে। ৩. কেউ কেউ বাসার ঠিকানা চায়, আমার কাছে কুরিয়ার সার্ভিসে সিভি পাঠানোর জন্য। মেইল আইডি থাকলেও সেটার ব্যবহার জানে না। ৪. সার্কুলার রিকোয়ারমেন্ট এ কি কি চাওয়া হয়েছে তা না বুঝেই কেউ কেউ সিভি পাঠিয়ে দেয়। ৫. সাবজেক্ট লাইনে কেউ কেউ “ভাড়ে মা ভবানী” উল্লেখ করে, আবার কেউ কেউ সালেক কম্পিউটার/ মালেক কম্পিউটারের দোকানের নামেই চালিয়ে দেয়। ৬. কেউ কেউ মেসেঞ্জারে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করে- “ভাই সিভিতে কি ছবি দিবো?” “ভাই সিভি কি বাংলায় নাকি ইংরেজিতে দেবো?” ৭. সিভি পাঠিয়েই- ‘জয়েন করতে হবে কত তারিখে?’ ৮. সরাসরি প্রশ্ন – ‘কাজ কি অফিসে নাকি বাইরে? বেতন কত? ৪০/৫০ হতে পারে কি? এলাকায় দিলে ভালো হতো!!
সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাঃ আমার অধিনে কিছুদিন আগে একজন এসিস্ট্যান্ট টেরিটরি ম্যানেজার নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। যদিও সে একজন টেরিটরি ম্যানেজারের এর অধীনে নিয়োগ পাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের সঠিক পরিচর্যা ও পরিচালনার স্বার্থে একধাপ এগিয়ে আমাদের অধীনে দেওয়া হয়েছে। এন্ট্রি লেভেল ম্যানেজারিয়াল জব। সাধারণত এমন সুযোগ খুব কমই আসে। প্রথম তিনমাস ২০/২২ এর মত বেতন। কর্মদক্ষতার উপর ভিত্তি করে তিনমাস পরে কনফার্মেশন হলে ২৫/৩০ এর কোটায় বেতন যাবে। আমার সাথে তার কথা হয় ফোনে। ১৮ তারিখে অফিসিয়াল কাগজপত্র ও কর্পোরেট পরিচয়পত্র সহ বিভিন্ন আনুষঙ্গিক কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে। ১৯ তারিখে ফিল্ডে আমার সাথে দেখা করার কথা থাকলেও সে সেদিন আসে না। আমি ফোন দিলে উত্তরে জানায়- “স্যার একবারে ২০ তারিখ থেকে শুরু করবো”। আমি তাতে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বললাম- “ওকে বেস্ট অফ লাক, আসেন।” ২০ তারিখে সারাদিন তাকে ফিল্ড ওয়ার্কের ফ্রেম ওয়ার্ক, ক্যারিয়ার গ্রোথ, ক্যারিয়ার প্ল্যান, টু-ডু, নট-টু-ডু, রেসপনসেবলিটি, জব ডেসক্রিপশন ইত্যাদি ইত্যাদি মোটামুটি বোঝানোর চেষ্টা করলাম। উল্লেখ্য যে- সে প্রায় আমার বয়সী (একটু জুনিয়র), ফ্রেশার, এটা তার প্রথম জব।
সে আমাকে প্রশ্ন করেছিলো- “আপনার চাকরির বয়স কত?” উত্তরঃ ১ দশক। যাইহোক পরদিন তাকে রুট ওয়ার্ক সম্পর্কে ধারনা দিতে একজন সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ এর সাথে মার্কেটে পাঠালাম। মার্কেট থেকে ফিরে সে আমাকে ফোন দিলো। তার সাথে শেষ দুবার যে কনভারসন গুলো ছিলো তার হুবহু কথাগুলো একটু একটু করে তুলে ধরলামঃ তুষার(ছদ্মনাম)- স্যার স্লামালেকুম আমিঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম। কি অবস্থা ভাই? বের হয়েছেন? তুষারঃ কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে – স্যার একটা কথা বলবো। আমিঃ হ্যা বলেন, তুষারঃ এ চাকরিটা আমি করবোনা। এটা আমার জন্য না। আমিঃ কোনো সমস্যা ভাই? তুষারঃ না স্যার। আসলে মার্কেটে এরকম পরিশ্রম করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমাকে দিয়ে হবেনা। আমিঃ আমি আপনাকে বলেছিলাম না? অনেকদিন পর ক্রিকেট খেললে শরীরটা একটু ব্যথা করে, কয়েকদিন পর সব ভালো হয়ে যায়, ভালো লাগা শুরু হয়। আপনারও ভালো লাগবে, লেগে থাকেন, আপনি পারবেন। এক কাজ করেন – আজ রেস্ট নিয়ে আগামীকাল আমার সাথে দেখা করেন। দুজনে বসে গল্প করি। তুষারঃ না স্যার সম্ভব না।
এটা বলেই ফোনটা কেটে দিলো। পরবর্তীতে তাকে আরও কয়েকবার ফোন দিয়েছি, কিন্তু আর কখনোই আমার ফোনটি রিসিভ হয়নি।
আসল কথায় ফেরা যাক। ছেলেটি এখন ৫০+ বেতনের চাকরি চায়, এসি কোটেড অফিস চায়। কারন সে এমবিএ ধারী। অথচ আমরা প্রায় একই বয়সী। আমার চাকরির বয়স ১০ বছর তার ১০ দিনও না।
এমন লক্ষ লক্ষ ভাই বোনেরা শুধুমাত্র চাকুরি দাতাদেরকে আর নিজের বাপ-মাকে গালিগালাজ আর অভিসম্পাত করেই দিনাতিপাত করছেন। মামা খালুর গুষ্টি উদ্ধার করছেন, আর বস্তা বস্তা হতাশার কেনাবেচা করছেন বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে।
আসলে আমাদের ভুলের বীজটা বপন হয় ছাত্রজীবন থেকে। কোথায় যেতে চাই আমি, সেখানে যেতে হলে কোন গাড়ীতে উঠবো আমি, কোথায় নামবো সেগুলো কিছুই ফিক্স করিনা আমরা অধিকাংশে। যার ফলে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর পত্রিকার পাতা কিংবা ফেসবুকের নিউজফিডে চাকুরির বিজ্ঞপ্তি দেখলেই আবেদন করে ফেলি।
বর্তমান সময়ে একটা চাকরি আসলেও একটা সোনার হরিণ। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা দিন দিন যে হারে বাড়ছে সে হারে তো কর্মক্ষেত্র বাড়ছে না। তাই চাকরির বাজারের ভবিষ্যৎ দিনে দিনে কঠিন হচ্ছে এবং আরোও কঠিন হবে।
তবে এতো এতো নেগেটিভ কথার ভেতরেও আশার বাণী হলো যারা নিজেকে সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে উপস্থাপন করতে পারবে তারা অবশ্যই চাকরি পায় এবং পাবে।
আপনার কাছে প্রশ্ন হলো চাকরির বাজার কঠিন হবে কাদের জন্য? জ্বি ঠিক বলেছেন কঠিন হবে তাদের জন্য যারা অযোগ্য। আসুন নিজেকে যোগ্য রূপে গড়ে তুলতে চাকরি পাওয়ার সহজ কৌশল এবং চাকরি পেতে করনীয় সম্পর্কে জেনে নিই।
দরকারিঃ ১. সুন্দর ও স্টান্ডার্ড একটা সিভি ২. নিজের প্রোফাইলের সাথে সার্কুলার ম্যাচ করে আবেদন করতে জানা ৩. স্টান্ডার্ড একটা bdjobs Account- (সার্টিফিকেট অনুযায়ী) ৪. স্টান্ডার্ড একটা LinkedIn Account- (সার্টিফিকেট অনুযায়ী) ৫. স্টান্ডার্ড একটা Facebook Account- (সার্টিফিকেট অনুযায়ী) ৬. স্টান্ডার্ড একটা Gmail Account- (সার্টিফিকেট অনুযায়ী) ৭. মাসে একটা হলেও ক্যারিয়ার ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট রিলেটেড ট্রেনিং করা ৮. বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ ও সখ্যতা তৈরী করা। যাকে বলা হয় নেটওয়ার্কিং। ৯. শুরু থেকে শুরু করার মনমানসিকতা থাকা ১০. কোনো কাজকেই ছোটো করে না দেখা ১১. কমপক্ষে ৩ জন ক্যারিয়ার কোচ নির্বাচন করে তাদের সান্নিধ্যে যাওয়া। ১২. বেতনের চিন্তা না করা ১৩. যেকোনো মূল্যে গ্রাজুয়েশন চলাকালীন কোনো না কোনোকিছু শুরু করার প্রবল মনোবাসনা। ১৪. সময়ের সাথে সাথে টেকনোলজির প্রতিটি আপডেট ভার্সন আয়ত্তে আনা। ১৫. বডি ল্যাঙ্গুয়েজ স্টান্ডার্ড রাখা ( আঁকাবাকা, ফ্ল্যাট সোজা কোনোটাই না, জাস্ট বুকে দম রেখে হাঁটা চলা, কথা বলা)
বর্জনীয়ঃ ১. ভাইয়া/স্যার একটা চাকরি দেন বলা। ২. স্বর্গের রাজকুমার, একলা আকাশ নামে ফেসবুক লিংকড-ইন, জিমেইল একাউন্ট ৩. কপি পেস্ট করে সিভি আপডেট করা ৪. ১৯৭১ সালে তোলা ছবি সিভিতে দেয়া ৫. সিভি ওয়ার্ড কিংবা পিডিএফ বাদে দেয়া ৬. বাড়ীর জেলাতে পোস্টিং চাওয়া ৭. উচ্চাভিলাষী বেতনের মনোবাঞ্ছা ৮. রাগ/লজ্জা/ভয়/দ্বিধা ৯. কম শুনে বেশি বলার চেষ্টা করা ১০. ঘরকুনো হয়ে বসে থাকা
সবশেষে বলবো-
* ছাত্র জীবন থেকেই নিজেকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করুন। মিশতে ও মেশাতে চেষ্টা করুন।
* ছাত্রজীবন থেকেই কম্পিউটার ওয়ার্ক, অফিস প্রোগ্রাম যেমন- ওয়ার্ড, এক্সেল , পাওয়ার পয়েন্ট ইত্যাদিতে ও টেকনোলজিতে একটু একটু করে আপডেট হতে শুরু করুন।
* ২০-এ কিছু না কিছু শুরু করুন। ২৫-এ গিয়ে আপনার অভিজ্ঞতার বয়স হবে ৫ বছর। তখন চাকুরি-ই আপনাকে খুঁজবে।
খন্দকার শফিকুল হাসান উজ্জ্বল, এরিয়া সেলস এক্সিকিউটিভ, পেপসিকো ইন্টারন্যাশনাল
Pbn24
©2020-pbn24.com প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | Design MasudTech